header ads

রবীন্দ্রনাথের 'কর্ণকুন্তীসংবাদ' ; প্রসঙ্গ : কুন্তী | Bengali article by Dr. Sumita Bhattaacharjee

 রবীন্দ্রনাথের 'কর্ণকুন্তীসংবাদ' ; প্রসঙ্গ : কুন্তী 



         পাশ্চাত্য সৃষ্টিমুুখীন সভ্যতার অভিঘাতে সৃষ্ট নবজাগরণের আলোয় আলোকিত জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জন্ম ৭মে,১৮৬১ সাল এবং মৃৃত্যু ৭আগস্ট, ১৯৪১ সাল। সমস্ত জীবনে অজস্র কাব্য, নাটক, গল্প আদির স্রষ্টা। এই কবি তাঁর 'গীতাঞ্জলি' নামক গ্রন্থটির জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই সর্বকনিষ্ঠ সন্তানটি ছোট থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় সভ্যতারই খোলা হাওয়ায় বড় হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে উপনিষদের শান্তগম্ভীর জ্ঞানবৃক্ষ বাল্যাবধি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। কাজেই সমস্ত দিক থেকে সমৃদ্ধ এই মানুষটি যে উনিশ শতকীয় নবজাগরণী জোয়ারে ভেসে অতীতের দিকে ফিরে তাকাবেন তা তো খুবই স্বাভাবিক। বস্তুত বঙ্গীয় নবজাগরণের অন্যতম লক্ষণই ছিল 'back to ourselves'। এই অতীতের টানই তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে 'রামায়ণ', 'মহাভারত'এর যুগে। এর ফলশ্রুতিতে তিনি রচনা করেছেন নানা কাব্যনাটক। বর্তমানে আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো বিশ্বকবির এমনই একটি রচনা 'কর্ণকুন্তীসংবাদ'।
     
              'মহাভারত' এর উদ্যোগপর্বে কুন্তী যুদ্ধের আগে পাণ্ডবদের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে কর্ণকে কৌরবপক্ষ ত্যাগ করে পাণ্ডবপক্ষে যোগদান করবার জন্য অনুরোধ জানাতে গিয়েছিলেন। সেসময় কুন্তী ও তাঁর বিবাহপূর্ব প্রথম সন্তান কর্ণের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত মাতা-পুত্রের মানসিকতা অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের লেখা কাব্যটির নাম 'কর্ণকুন্তীসংবাদ'।

             মূল 'মহাভারত'এ কুন্তী কর্ণের কাছে এসেছিলেন নিতান্ত স্বার্থের তাড়নায়, তাঁর অপর পাঁচ পুত্রকে যুদ্ধে সুরক্ষিত রাখার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কুন্তী অন্যরকম। যদিও তিনি কর্ণের কাছে এসেছিলেন প্রয়োজনেরই তাগিদে। কিন্তু পঞ্চপুত্রে ধন্য কুন্তীর কোলে বিধাতার অধিকার নিয়ে যে ক্ষুদ্র শিশুটি একদিন এসেছিল, তাকে ত্যাগ করার অপ্রতিকার্য অন্যায়ের কষ্টে কুন্তী মনে মনে আজও অনুতপ্ত। কুন্তীর মাতৃত্বের আবেদন সমালোচকের ভাষায় রূপ পেয়েছে এভাবে - "এই কানীন পুত্রটির বিচ্ছেদে তাঁহার মাতৃহৃদয়ে দুঃখের অন্ত ছিল না। মূল কুন্তীচরিত্রে সে ভাব আছে মনে হয় না।" কিন্তু সমালোচকের এই উক্তির সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণভাবে একমত হতে পারি না। কেননা 'মহাভারত' এ রয়েছে যে, হস্তিনাপুরে অস্ত্রপরীক্ষায় কর্ণ ও অর্জুনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রস্তুত দেখে কুন্তী মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। কাজেই কুন্তীর মাতৃহৃদয়ে যে বেদনা ও দ্বন্দ্বের ভাবটি ছিল তা বেদব্যাসের লেখনীতেই বীজাকারে রয়ে গিয়েছে। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রলেখনীতে তা পুষ্পিত ও বিকশিত হয়েছে।

             'কর্ণকুন্তীসংবাদ' এর কুন্তীর মধ্যে অনেকে নানা দোষ আবিষ্কার করেছেন। কারও মতে, "কর্ণকুন্তীসংবাদে মাতৃধর্মের নিষ্ঠুর অবহেলা দেখানো হয়েছে...।" আবার কেউ বা কর্ণের বিদ্রোহী হবার পশ্চাতে লোকভয়ে, সমাজভয়ে কুন্তীর আদিম মাতৃত্বধর্মের অবমাননাকেই দর্শন করেছেন। কিন্তু আমরা স্মরণ করতে পারি কুন্তীর সেই মর্মভেদী  সংলাপ -
               
                      " .... ত্যাগ করেছিনু তোরে,
                          সেই অভিশাপে পঞ্চপুত্র বক্ষে ক'রে
                           তবু মোর চিত্ত পুত্রহীন;...," 

             প্রথম যৌবনের বালচাপল্যের ক্ষণিক ভুলের ফলশ্রুতিতে সারাজীবনব্যাপী প্রায়শ্চিত্তের টানে লজ্জাতুরা মাতৃহৃদয়ের হাহাকার- অসীম এর মূল্য। কী তীব্র এই বেদনা! আমাদের এই মতের সমর্থন আমরা পেয়েছি জনৈক সমালোচকের কথায়। সমালোচক শুদ্ধ ত্যাগের মূর্চ্ছনায় তীব্র কুন্তীর প্রায়শ্চিত্তকে দেখেছেন ধৃতরাষ্ট্রাদির সঙ্গে কুন্তীর বনগমনের মধ্যে। তাঁর ভাষায়, "কর্ণের জন্য তাঁর যে অন্তর্জ্বালা, যে অনুতাপ তা নিয়ে কুন্তীর আর গৃহসুখে বাস করা সম্ভব নয়। কেউ না জানুক, তিনি তো জানেন, কর্ণ শুধু তারই অনুরোধে প্রাণত্যাগ করেছে। মনে মনে তিনি পুত্রঘাতিনী হয়ে আছেন। তাই ধৃতরাষ্ট্রের মত কুন্তীরও আর সংসারে ঠাঁই নেই।" মোটকথা, রবীন্দ্রনাথের কুন্তী এক অনুতপ্ত মাতা অথচ তিনি বিশ্ববিধানের সত্যের লীলাকে মেনে নেবার জন্য গান্ধারীর মতো নতশিরে প্রতীক্ষা করবার ধৈর্য রাখেন না। তাই ধর্মের বিধানকে তিনি এক অভিশাপ ও সুকঠোর দণ্ড বলেই মনে করেন। এখানে তিনি 'নিয়তির হাতে দুর্বল ক্রীড়নক' মাত্র। সামাজিক ধর্মপালনের লোভে যেদিন তিনি ক্ষুদ্র শিশুটিকে জলে ভাসিয়ে দিলেন তাঁর সেই পাপেই কর্ণের জীবনের অপচয় ঘটেছে - এ সত্য তিনি বুঝতে পারলেও আত্মদহন ও আত্মসংশোধনের মধ্য দিয়ে নিয়তি যে পূর্ণের পথে এগিয়ে চলেছে - এ সত্য বুঝতে তিনি অপারগ। তাই তিনি বলেন, -
              
                 "... হায় ধর্ম, একি সুকঠোর
                দণ্ড তব! সেইদিন কে জানিত, হায়,
                ত্যজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়
                সে কখন বলবীর্য লভি কোথা হতে
                ফিরে আসে একদিন অন্ধকার পথে,                      
                আপনার  জননীর কোলের সন্তানে
                আপন নির্মম হস্তে অস্ত্র আসি হানে! 
                একি আভিশাপ! "

         প্রখর মাতৃত্বের আবেদনঋদ্ধ যে কুন্তীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার বাচনভঙ্গিমা প্রমাণ করে দেয় যে, এখানে কুন্তীর স্রষ্টা আধুনিকমনস্ক। এই কুন্তী একেবারেই অভিনব - আর এখানেই রবীন্দ্রনাথের মহত্ব। 

***********************



ড° সুমিতা ভট্টাচাৰ্য 
সহযোগী অধ্যাপিকা
বাংলা বিভাগ
আর্য বিদ্যাপীঠ কলেজ






অলংকৰণ :- তন্দ্রা দে



Post a Comment

1 Comments

  1. বাহ এটি পড়ে খুব ভালো লাগলো কুন্তীর আজ এক নতুন দিক জানতে পারলাম এক নতুন দিক আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হলো

    ReplyDelete