header ads

মিষ্টির শিশু দিবস । Bengali Story by Maskura Begom

 মিষ্টির শিশু দিবস



ডাক্তার মিঃ আহমদ ও  মিসেস আহমদের এক ছেলে, এক মেয়ে। ওরা শহরের নামকরা বেসরকারি স্কুলে পড়ে। ছেলে আদিল ক্লাস নাইনে ও মেয়ে আয়েশা ক্লাস ফাইভে। ছেলেটা রাতদিন  পড়াশোনা, মিউজিক, যোগব্যায়াম ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন্ত। মা-বাবার গর্ব আদিল। আয়েশাও পড়াশোনায় দারুণ, চটপটে মেয়ে, অমায়িক আর মিশুকে। স্কুলের শিক্ষক - শিক্ষিকারা ওকে খুব ভালোবাসেন। ও আঁকতে, আবৃত্তি করতে, গল্পের বই পড়তে আর বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসে। কিন্তু মা-বাবার ওকে নিয়ে যত চিন্তা। নিজের মা-বাবার সোশ্যাল স্ট্যাটাস ও তো বোঝে না। ভিখারি দেখলে ও গল্প জুড়ে দেয়, ফুটপাতের বাচ্চাদের  সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়। কাজের লোকের সঙ্গেও ওর ভাব জমে যায়। নিজের খাবার ওদেরকে দিয়ে দেয়। 

       ১৪ই নভেম্বর শিশু দিবস। দিনটি পালনের তোড়জোড় চতুর্দিকে। আয়েশা ও আদিলের স্কুলেও সেলিব্রেশন। আয়েশা 'অঙ্কন প্রতিযোগিতা' আর 'গল্প বলা প্রতিযোগিতা'য় অংশগ্রহণ করবে। মা-বাবার ইচ্ছে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ও অংশগ্রহণ করুক । ওর সঙ্গীতে এতো আগ্রহ নেই তবুও মা-বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে নাম দিল একটা দলীয় সঙ্গীতে আর একটা দলীয় নৃত্যে । আধুনিকতার দৌড়ে তাদের ছেলে-মেয়েরা যাতে পিছিয়ে না যায়, সবসময় খেয়াল রাখেন মিঃ আহমদ ও মিসেস আহমদ। তাদের ছেলে-মেয়ের পারফরম্যান্সটাও তো সোশ্যাল মিডিয়ায়  আপলোড করতে হবে। সেদিন মিসেস আহমদের এক বান্ধবী শেয়ার করেছেন, স্বাধীনতা দিবস উৎযাপন উপলক্ষে তার মেয়ে কী চমৎকার  নৃত্য পরিবেশন করেছে ! তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়েশা সঙ্গীত পরিবেশনে আর নৃত্য পরিবেশনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য। ওর আর ভাইজানের জন্য মা-বাবার সারপ্রাইজ গিফট তো আছেই শিশু দিবসে।

 সেদিন নভেম্বরের ১৩ তারিখ। মা ব্যস্ত পরের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে। বাজারে থেকে গাড়ি ভর্তি কেনাকাটা করে ঘরে ফিরলেন। তাদের ঘরে আরো একটি প্রাণী আছে। বারো বছরের কাজের মেয়ে মিষ্টি। 'যেমনি নাম তেমনি  মিষ্টি' - আয়েশার মতে।

  "এই পোড়ারমুখী তুই এতক্ষণ কী করছিলি? ঘরের সব কাজকর্ম এখনও পড়ে আছে। কালকের প্রস্তুতি করতে হবে বুঝতে পারছিস নাা?"  মা বাজার থেকে এসে চেঁচাতে লাগলেন।

 " ওতো সারা দিন কাজই করছিল...." আয়েশা বলা শেষ করার আগেই ওর উপর মা রেগে গেলেন। ও চুপচাপ সামনে থেকে চলে গেল। 

    মায়ের রাগ দেখে ভয়ে মিষ্টির হাত থেকে মায়ের জন্য নিয়ে আসা জলের গ্লাসটা পড়ে যায় মেঝেতে। 

    ওকে এক চড় বসিয়ে মা বললেন, "গত বৎসর কাঠমান্ডু থেকে নিয়ে আসা আমার এতো দামি গ্লাসের সেটটার একটা গ্লাস রাগ করে ভেঙে দিলি?" 

 ১৪ নভেম্বর সকালে মা-বাবা রঙিন কাগজে মোড়া সারপ্রাইজ গিফট বের করলেন ছেলে আদিল ও মেয়ে আয়েশার জন্য । আদিল গিফট হাতে নিয়ে খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে মা-বাবাকে আদর করলো।

" আয়েশার  গিফট দেখে পরে আমারটা খুলবো", আদিল বলল। আয়েশা গিফট হাতে না নিয়ে জিজ্ঞেস করল, "মিষ্টিদির জন্য কী এনেছ মা?" 

     মা কিছু বললেন না, আজকে শিশু দিবস, মেয়েকে দুঃখ দিতে ইচ্ছে করলো না বোধহয়। আজ প্রাতরাশে ওদের পছন্দের অনেক খাবার। কিন্তু আয়েশা খুশি নয়। ও সাধারণ খাবার খেয়ে উঠে চলে গেল। মা চুপচাপ লক্ষ্য করলেন। স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়ে এলো আয়েশা।  

" মা তুমি রেডি হলে না?" আয়েশা বলল।    

না, তোমরা যাও।" মা বললেন।

"ওকে, বাই।" বলে ওরা বাবার সঙ্গে চলে গেলো।

     স্কুলের অনুষ্ঠান আরম্ভ হল। প্রিন্সিপাল মহোদয়ের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন, সভাপতির ভাষণ, অতিথিদের ভাষণ, ছাত্র ছাত্রীদের পরিবেশিত নাচ - গান সবাইকে খুব আনন্দিত করল। শিশুদিবস,  শিশু অধিকার ও শিশু নির্যাতন ইত্যাদি নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেন। এবার এলো ছাত্র-ছাত্রীদের গল্প বলার পালা । আয়েশার খুব ভালো লাগে গল্প বলতে। ওর নাম ডাকা হলো। ও মঞ্চে উঠে বলতে শুরু করলো, 

         "একটি মেয়ের গল্প। ওদের চার ভাইবোনদের রেখে বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আগে তিনি পেশায় মিস্ত্রী ছিলেন। কোনোমতে সংসারটা চলে যেত। ওরা ওদের বাড়ির পাশেই একটা সরকারি স্কুলে পড়তো। কিন্তু বাবা অসুস্থ হওয়ার পর মায়ের উপর সংসারের বোঝা এসে পড়ে  আর তিনি অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করলেন। একদিন বাবা এই পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন ওপারে। মা নিজে  কাজ করেও  সংসার চলছে না দেখে বড় মেয়ে মেহেরুন্নেসা ওরফে মিষ্টিকেও দিয়ে দেন কাজে। মাসে মাসে টাকা পাচ্ছেন, সংসার খরচে সাহায্য হচ্ছে। কিন্তু মিষ্টির স্কুল যাওয়া বন্ধ। ও এখন অনেক সমঝদার। দুষ্টুমি করে না। অনেক বড় হয়ে গেছে। কেউ যাতে কোনো কষ্ট না পায় সবসময় খেয়াল থাকে ওর। আনন্দ ফুর্তি করে না। দুঃখও করে না। একটা মিষ্টি হাসি লেগে থাকে মিষ্টির মুখে। মিষ্টির কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার কিছু পেলেই পড়ে। আজ আমার জন্য কী সুন্দর HAPPY CHILDREN'S DAY  লেখা কার্ড  বানিয়েছে " বলে আয়েষা একটা সুন্দর হাতে বানানো কার্ড  বের করে দেখায় আর উপস্থিত সবাইকে সম্বোধন করে বলে উঠে,

      " এখানে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় গুরুজনমণ্ডলী আপনারা কেউ কি মিষ্টির পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারবেন?" 

      তখন সভাপতি মহোদয়  বললেন, " হ্যাঁ আয়েশা। একজন মিষ্টির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন।" বলে ঘোষণা করলেন, "আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মিসেস আহমদকে এই মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার জন্য।"

   মঞ্চে মিষ্টিকে সঙ্গে করে ওর মাকে উপস্থিত হতে দেখে আয়েশা নির্বাক হয়ে নিষ্পলক  তাকিয়ে থাকে ! কী সুন্দর পোশাকে সেজেগুজে মিষ্টি ! 

  "আমি মিষ্টির দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। ওর পড়াশোনা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব্ এখন আমার  আর ওর পরিবারকে আর্থিক সাহায্যও করে যাবো । আমার মেয়ে আয়েশা সোনামনিকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই আমার মধ্যে মানবিকতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য।" বলে মা কোলে তোলে নেন আয়েশাকে। আর আয়েশা ওর মাকে ও মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে মহানন্দে।          

          বাজতে থাকে করতালি । চতুর্দিকে। আর 'Happy Children's Day' স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে সমস্ত অডিটোরিয়াম। 


                      

লেখকের ঠিকানা:

মাসকুরা বেগম ।

সহকারী শিক্ষয়িত্রী ।

চাম্পুপারা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ।

শিক্ষাখন্ড - ছয়গাঁও, কামরূপ। 

Post a Comment

0 Comments