শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে মাতৃভাষার গুরুত্ব
"আমাদের মধ্যে যাহা কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা কিছু অমর করিবে সেই সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার, পোষণ করিবার, প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় মাতৃভাষা।"---- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।
নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যমকে সংক্ষেপে ভাষা বলে । একজন মানুষ জন্মগ্রহণ করার পর প্রথম যে ভাষার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে সেটাই তার মাতৃভাষা । স্বাভাবিকভাবেই একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই কাঁদে - এটা তার ভাষা নয়, ধ্বনি । সে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ধ্বনি থেকে শব্দ, শব্দ থেকে অর্থপূর্ণ শব্দ, তারপর আধো-আধো বাক্য থেকে অর্থপূর্ণ বাক্যের প্রয়োগ করতে শিখে ফেলে । শিশুটি মাতৃদুগ্ধ, পানীয়, খাদ্য, পৃথিবীর আলো বাতাসে যেমন পুষ্টি লাভ করে, ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে তেমনি মাতৃভাষা তার মানসিক বিকাশকে, ভাবনার জগতকে বিকশিত করে । এই মাতৃভাষা সে আয়ত্ত করে তার মায়ের মুখ থেকে, পরিবারের সদস্য ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে।
একটি শিশুর জন্য এই মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ । মাতৃভাষায় কোনো কিছু শিখলে তা তাদের সহজেই বোধগম্য হয় । কারণ মাতৃভাষার বিভিন্ন শব্দের সঙ্গে তাদের পূর্ব পরিচিতি থাকে । তাই সহজেই সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে তাদের প্রতিভার প্রকাশ করতে পারে। গঠনমূলক সমালোচনা, উদ্ভাবনীমূলক কাজেও নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ফুটিয়ে তুলতে পারে । মাতৃভাষার সঠিক জ্ঞানের ফলে তারা দ্বিতীয় ভাষাকেও সহজেই আয়ত্ত করতে পারে এবং অন্য ভাষায়ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে । ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সমন্বয় ঘটিয়ে অবশেষে তারা পারদর্শিতার সাথে জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারে । এমন অনেক উদাহরণ আমরা আমাদের চারপাশে ভালো করে তাকালেই দেখতে পাই । মাতৃভাষায় অধ্যয়ন করে আজ বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন - ড. এ পি জে আবদুল কালামের মত অনেকেই।
মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার সবচেয়ে সহজ- সরল ও শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে মাতৃভাষা । হৃদয়ের যত আবেগ- অনুভুতি, কল্পনার যত আলপনা, স্বপ্নের রাজ্যের যত কাহিনি, ভাবনায় বোনা শব্দের যত ঝঙ্কার, কবিতার যত ছন্দ, গানের যত কলি সুনিপুণ ভাবে একমাত্র মাতৃভাষাতেই প্রকাশ করা সম্ভব । মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের গভীর ও অন্তরঙ্গ আন্তরিকতা থাকার ফলে তার চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধির সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে । মাতৃভাষা শিশির ভেজা ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ার মত। মাতৃদুগ্ধের মত মাতৃভাষা মন- মস্তিস্কের পুষ্টিকর আহার। তাইতো প্রমথ চৌধুরী মাতৃভাষাকে বলেছেন, "বুদ্ধিবৃত্তির সঞ্জীবনী রসায়ন"। নোবেল জয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, - "ইংরাজি আমাদের পক্ষে কাজের ভাষা, কিন্তু ভাবের ভাষা নহে ।" কবিগুরু মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন মাতৃভাষার গুরুত্ব ।
পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছিল । ইংরাজি সাহিত্য- সংস্কৃতির মোহে পড়েছিলেন অনেক শিক্ষিত মানুষ । যখন তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মাতৃভাষার গুরুত্ব, ফিরে এসেছিলেন নিজ মায়ের বুকে, হৃদয়ে জড়িয়ে ধরে ছিলেন মাতৃভাষা । এমনি একজন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যিনি ইংরাজি ভাষায় পারদর্শী হয়েও বাংলা ভাষায় রচনা করে বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন আমাদের মাঝে । তিনি তাঁর "বঙ্গভাষা " কবিতায় লিখেছেন,
"ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে।"
মাতৃভাষা আয়ত্ত না করলে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব নয় । মাতৃভাষার অজ্ঞতার কারণে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্পূর্ন ভাবে হতে পারে না । তারা খুব একটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে না । মাতৃভাষা শিক্ষার অভাবে কিছুটা হীনমন্যতায় ভোগে তারা। তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে না । ফলে নিজের মানুষগুলোর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যেতে পারে, সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি অজানা রয়ে যেতে পারে ; যার জন্য তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারে তার সমাজ-সংস্কৃতিকে। মাতৃভাষার মাধ্যমে সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ভূগোল অতি সহজেই আয়ত্ত করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। নিজের আবেগ-অনুভূতি সৃষ্টিশীলতা দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে, উদ্ভাবনীমূলক তথা গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করতে পারে নিজের দেশ ও জাতিকে । তাই আমাদের অকপটেই স্বীকার করতেই হবে যে মাতৃভাষা একটি শিশুর সর্বাঙ্গীণ ব্যক্তিত্বের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
![]() |
মাসকুরা বেগম। |
সহকারী শিক্ষয়িত্ৰী ।
চাম্পুপারা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল ।
ছয়গাঁও শিক্ষাখন্ড l
তথ্য সূত্র :
1. https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/
2. https://www.banglaukti.com/2020/11/
3. https://www.pathgriho.com/2021/09/
4. https://www.proshikkhon.net/
5. https://bengaliforum.com
6. https://www.ebookbou.edu.bd
0 Comments