header ads

বাংলা লেখা ,শৈলচূড়ায় , ৩য় বছৰ ৩য় সংখ্যা,

 শৈলচূড়ায়      



   খুব সম্ভবত দশ বারো বছর আগের ঘটনা । ঘটনাটি ছোট । হয়তো কারও চোখেই পড়েনি । আমার চোখে পড়েছিল এবং আমাকে ভাবিয়েওছিল । আমার ভাবনাটা অন্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হলে মন্দ তো কিছু হবে না ভেবেই এই লেখার অবতারণা ।
       আমার , আর আমার স্ত্রী মণিকার , একসময় সাধ হয়েছিল দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করার । সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে আমরা পৌঁছে গেলাম মহারাষ্ট্রের ভীমাশঙ্করে । ভীমাশঙ্কর পশ্চিম মহারাষ্ট্রে সহ্যাদ্রি পাহাড়ের প্রায় চার হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত । পুণে শহর থেকে একশো পাঁচ কিলোমিটার । পাহাড়ি আকাবাঁকা পথে উঠে যেতে বেশ লাগে । পাহাড়ের চূডায় টুকরো টুকরো জায়গা কেটে সমান করে ছোট ছোট দোকানপাট বসেছে । ছোট্ট একটি বাস স্টেশন । পুণে থেকে দিনে দু-একটি সরকারি বাস যাতায়াত করে । থাকার ভালো জায়গা নেই । সাধারণত তীর্থযাত্রীরা গাড়ি নিয়ে গিয়ে দর্শন পূজাদি সেরে সেদিনই ফিরে যায় । বাস স্টেশনেই গাড়ি পার্কিঙের ব্যবস্থা । ছোট্ট স্টেশন চত্বরের একদিকে রাস্তা ; একদিকে দুটি চা-জলখাবারের দোকান , টিকিট ঘর ; আর দুদিকে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে অনে..ক নীচে । দোকান দুটোয় কোনো দরজা বা ঝাঁপ নেই । সন্ধ্যার পর এই তীর্থক্ষেত্রে যাত্রী প্রায় থাকেই না । দোকানেও খদ্দের থাকে না ; কিন্তু ঝাঁপও পড়ে না ।
        মন্দির স্টেশন চত্বর থেকে অনেকটাই নীচে । ঢালু পায়ে-হাঁটা পাকা রাস্তা ধরে নেমে যেতে হয় । অনেকটা পর পর একেকটা ধাপ । সকালে গিয়ে পূজো দিয়ে কিছুক্ষণ মন্দিরেই বসে থাকলাম । ভক্তরা আসছে পূজো দি‌চ্ছে । চতুর্দিক ধূপধুনার গন্ধে আমোদিত । ভিড়‍ভাড় ঠেলাধাক্কা কিছুই নেই । একসময় পেট জানান দিতে শুরু করল -- সকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি । ধীরে ধীরে উঠে এলাম ওপরে স্টেশনের সেই চা-জলখাবারের দোকানে ।
        ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি । প্রায় এগারোটা বাজে । শীতের প্রকোপ নেই কিন্তু উচ্চতা আর পাহাড়ি বাতাসের জন্য শীতের বেশ একটা আমেজ ছিল । বাইরে রোদে বসেই পুরি ঘুগনি সহযোগে প্রাতরাশ সেরে চা খাচ্ছিলাম । নরম রোদের কোমল স্পৰ্শটাও বেশ উপভোগ্য ছিল । তখনই ঘটনাটা ঘটে । আমাদের বসা জায়গাটি থেকে অদূরেই ।
        একটা ঝাঁ-চকচকে নীল রঙের বাস এসে থামল । বাসটার গায়ে সাদা রং দিয়ে একটি বিদ্যালয়ের নাম লেখা । যদ্দূর মনে পড়ে বিদ্যালয়ের প্রতীকও আঁকা ছিল । বাস থেকে কুড়ি পঁচিশ জন ছাত্র-ছাত্রী নামল । তাদের গায়ে বিদ্যালয়-পোশাক । মনে হল ওপরের শ্রেণিতেই পড়ে । একজন মধ্যবয়সী পুরুষ ও একজন মহিলাও নামলেন । মনে হল এঁরা দুজন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্ৰী । দুজন ছাত্ৰ বাস থেকে একটা ড্রাম নামাল । মাঝারি আকারের । এটাও নীল রঙের । ড্রামটির ওপর দিক খোলা । দুদিকে দুটি লোহার কড়া লাগানো । শিক্ষকের নির্দেশে দুজন ছাত্র ড্রামটিকে দোকান দুটির কাছাকাছি রাস্তার পাশেই একটি গাছের নীচে নিয়ে গেল । দুটি কড়াতে শিকল ঢুকিয়ে গাছের সঙ্গে তালাবন্ধ করল । শিক্ষয়িত্ৰী এবার তিনখানা স্টিকার তিনজন ছাত্রীর হাতে দিলেন । তারা স্টিকার তিনটি খুলে ড্রামটার তিনদিকে লাগিয়ে দিল । তাতে ইংরেজিতে লেখা 'USE ME' । ড্রামটাকে মাঝখানে রেখে সবাই মিলে ফটো ওঠাল । তারপর বাসে উঠে চলে গেল । যে কাগজ থেকে স্টিকার তিনটি খোলা হয়েছিল সেই কাগজখণ্ডগুলো পাহাড়ি মলয় পবনের প্রভাবে এদিক থেকে সেদিক , সেদিক থেকে ওদিকে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর বলছে -- আমাদের ড্রামটির ভিতরে ফেললে খুশি হতাম । তোমরা আচার শিখলে কিন্তু আচরণ শিখলে না !!





সুশান্ত সরকার
গুয়াহাটি
-----------------------------------------------------
লেখক পরিচিতি -- শ্রী সুশান্ত সরকার বিদ্যলয়ের শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে সুদীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর বিভিন্ন ব্যাঙ্কে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব নির্বাহ করে ২০১৭ সনে অবসর গ্রহণের পর লেখালেখিকেই সাথী করেছেন । ইতিমধ্যে কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে । 

Post a Comment

1 Comments

  1. সত্যিই ভাববার বিষয়।আচার কাকে বলে;আর ,আচরণ বা কী!

    ReplyDelete