শিশুর ভাষার তথা শব্দ ভাণ্ডারের বিকাশে বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা
ভাষার বিকাশ তথা শব্দ ভাণ্ডারের বিকাশ শিশুর সার্বিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। একটি শিশুর তথা মানবজাতির যোগাযোগের মাধ্যম, তার আবেগ অনুভূতির প্রকাশের মাধ্যম হল ভাষা। সঠিক স্থানে সঠিক শব্দের প্রয়োগ একটি শিশুর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বহন করে। বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে শিশুটির সেই ভাষা, জ্ঞানের তথা শব্দ ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি হয়। সাহিত্য হচ্ছে একটি ভাষার বাহক। সাহিত্যকর্মে নতুন নতুন শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে একজন সাহিত্যিকের তার শিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার অস্ত্র। তাই শিশুর চিন্তা - ভাবনার সাবলীল বিকাশ ও প্রকাশের জন্য বয়সোপযোগী বিশ্ব- সাহিত্য অধ্যয়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ভাষা হলো একজন মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। এই ভাষা-জ্ঞান জগতের অন্যান্য জীব থেকে মানুষকে আলাদা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জন্মের পর একটি শিশু শুধু কিছু আওয়াজ বের করতে সক্ষম হয়, কিন্তু সে অর্থপূর্ণ শব্দ উচ্চারণে অক্ষম থাকে। ধীরে ধীরে সে শ্রবণ শক্তির মাধ্যমে শব্দ শিখে আধো আধো শব্দ উচ্চারণ করতে করতে একসময় পূর্ণ শব্দ বলতে শুরু করে তারপর একটু একটু করে তা বাক্যে প্রয়োগ করে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে অনর্গল কথা বলতে শিখে ফেলে।
শিশুর ভাষা তথা শব্দ ভাণ্ডারের বিকাশে পারিপার্শ্বিক বহু উপাদান প্রভাব ফেলে। যেমন, পরিবারের লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সংবাদ পত্র, বই - পুস্তক অধ্যয়ন ইত্যাদি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি থেকে যতটুকু ভাষা তথা শব্দ-ভাণ্ডারের জ্ঞান আহরণ করা যায় আর অন্য কোথাও থেকে ততটুকু সম্ভব হয় না। আর বিশ্ব সাহিত্য তো শিশুর ভাষা তথা শব্দ ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি বিশাল দুয়ার খুলে দেয় । তাদের জ্ঞানের পরিধির সীমানা বহুদূর ছাড়িয়ে যায় ।
'বিশ্ব সাহিত্য' শব্দটি ১৮২৭ সালে জার্মান ঔপন্যাসিক এবং কবি জোহান উলফগ্যাং গোয়েথে প্রথম ব্যবহার করেছেন তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে । বিশ্ব সাহিত্য হচ্ছে একটি দেশের কোনো জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম যা তার মানবতাবাদী বিষয়বস্তুর জন্য সীমানা অতিক্রম করে অন্যান্য দেশেও সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে । ডেভিড ড্যামরোশের মতে, "একটি কাজ দ্বৈত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্যে প্রবেশ করে। প্রথমত, সাহিত্য হিসেবে পঠিত হয়ে এবং দ্বিতীয়ত, তার ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক উৎসের বাইরে একটি বিস্তৃত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে"।
এমন অনেক সাহিত্যকর্ম রয়েছে যেগুলো বহুযুগ আগে রচিত হয়েছিল কিন্তু আজও সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে এবং খুব আগ্রহের সঙ্গে বিভিন্ন দেশে পঠিত হচ্ছে । দ্যা ওডিসি, ইলিয়াড, ডিভাইন কমেডি, অ্যারাবিয়ান নাইটস্ ( আলফুন ওয়া লাইলা) ইত্যাদি সাহিত্যকর্ম হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত।
ভাষা তথা শব্দ ভাণ্ডারের বিকাশের জন্য বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য ।
১/ শব্দ ভাণ্ডারের সমৃদ্ধি : বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন শিশুর শব্দ ভাণ্ডারের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । শিশুটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ আয়ত্ব করে নিজের শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারে ।
২/ নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিতি : সাহিত্য মানেই হচ্ছে ভাষার উৎকৃষ্ট রূপের প্রয়োগ, আকর্ষণীয় শব্দের সমাহার, ভাবাবেগ ও সমাজ সংস্কৃতির চিত্রপট। বিশ্ব সাহিত্য শিশুকে নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করার সুযোগ করে দেয়।
৩/ সমার্থবোধক শব্দ, বিপরীত শব্দ সংগ্রহ বৃদ্ধি : বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন শিশুকে শব্দের অর্থ, বিপরীত অর্থ, ইত্যাদি সমন্ধে জানতে আগ্রহী করে তোলে ।
৪/ অভিধানের ব্যবহার : বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন কালে একজন পাঠকের ভাষার বিভিন্ন ধরনের স্বতন্ত্র আভিধানিক উপাদানের মুখোমুখি হতে পারে । সেই কারণে সে সেই শব্দের তথা বাক্যের বোধগম্যতার প্রয়োজনে অভিধানের ব্যবহার শিখে ফেলে ।
৫/ শব্দের সঠিক প্রয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধি : বাক্যের সঠিক স্থানে সঠিক শব্দের প্রয়োগ একটি কলা। ভিন্ন ভিন্ন দেশের সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে শিশুটি শব্দের সঠিক প্রয়োগের দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
৬/ ভাষাগত জ্ঞান আহরণ : বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন একটি শিশুকে তার ভাষাগত দক্ষতা প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাহিত্য যেহেতু ভাষার বাহক তাই ভাষার উপাদান, উপকরণ, ধ্বনি, শব্দ ও বাক্যের মধ্যে সবগুলোর সঠিক প্রয়োগ সমন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা সহজ ও সুন্দর ভাবে একজন শিশুর বোধগম্য হয় । শিশুটি সেই ভাষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠে।
৭/ ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সম্বন্ধে জানার আগ্রহ : বিশ্ব সাহিত্য যেহেতু কোনো একটি ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তাই বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন একজন পাঠককে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সম্বন্ধে জানার জন্য আগ্রহী করে তোলে।
৮/ লেখালেখির দক্ষতা অর্জনের জন্য : বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন শিশুকে শব্দের প্রয়োগ, ব্যবহারের ধরণ তাদের নিজস্ব লেখার দক্ষতার বিকাশে সহায়তা করে ও তাদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। একটি শিশু যখন একটি শব্দের বা ভাষার পরিসর ও গভীরতা জানতে শুরু করে তখন সে নতুন ভাবে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠে।
৯/ভাষার ব্যাকরণের স্পষ্ট ধারণা : সাহিত্যকর্মে ব্যকরণের শুদ্ধ রূপ প্রয়োগের উপর জোর দেওয়া হয়। বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে শিশুটি বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণের প্রতি পরিচিতি লাভ করে এবং তার মধ্যে ব্যকরণের একটি স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয় । একটি শব্দের মূলঅর্থ, উপসর্গ, প্রত্যয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে জানার আগ্রহ তার ব্যাকরণগত জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে।
১০/ ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আয়ত্ব মাতৃভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করে : বিশ্ব সাহিত্যকর্ম কোন একটি ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় । তাই একটি শিশুকে মাতৃভাষার গণ্ডি থেকে বের করে অন্য ভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় । সাহিত্য অধ্যয়নের আগ্রহ একটি শিশুকে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা আয়ত্ব করতে আগ্রহী করে তোলে । ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ মাতৃভাষা সম্বন্ধে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি করে ও মাতৃভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।
১১/ ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে সংযোগ : পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে । ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় কোথাও না কোথাও গিয়ে প্রায় সব ভাষা একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে একটি শিশু বিভিন্ন ভাষার মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার সুযোগ পায়।
১২/ মস্তিষ্কের ব্যায়াম : বিশেষজ্ঞদের মতে বিভিন্ন ভাষার অধ্যয়ন মস্তিষ্কের একধরনের ব্যয়াম যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বিশ্ব সাহিত্য যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত তাই ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও শব্দ শেখার প্রয়োজন হেতু শিশুর মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে শিশু যত বেশি বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন করবে এবং আত্মস্থ করবে তত বেশি শব্দ ও ভাষাজ্ঞান তার মস্তিষ্কে সঞ্চিত হবে । একদিন নিশ্চয়ই বিশ্বের দরবারে তার সেই প্রতিভার সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ হবে। তাই একটি শিশুর ভাষা তথা শব্দ ভাণ্ডারের বিকাশে বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য ।
-------------------------
Source: 1. https://study.com
মাসকুরা বেগম
সহঃ শিক্ষয়িত্রী
চাম্পুপারা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়
শিক্ষাখণ্ড - ছয়গাঁও
0 Comments