header ads

বাংলা প্ৰবন্ধ l মুদ্রাহীন লেনদেনে অসমের পাঁচশত বছর l পূরবী দে l ৫ম বছৰ- ৩য় সংখ্যা

 মুদ্রাহীন লেনদেনে অসমের পাঁচশত বছর


" অসম আমার রূপহী,
   গুণরো নাই শেষ,
  ভারতরে পূর্ব দিশর 
    সূর্য উঠা দেশ । "

        শস্য-শ্যামলা ভারতবর্ষের ব্রহ্মপুত্র নদীর দ্বারা পরিপুষ্ট একটি সবুজ রাজ্য, নাম তার অসম ।প্রকৃতির দানে পরিপূর্ণ এই ভূমি । প্রাকৃতিক সম্পদে ঐশ্বর্যশালী এই রাজ্যের অর্থনৈতিক দিকটিও তেমনি চিরসবুজ । কৃষিপ্রধান রাজ্য অসমের প্রায় ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষের জীবিকা হলো কৃষিকাজ । পাহাড় তথা সমতলের বিভিন্ন জাতি-জনজাতির সমাবেশ হচ্ছে অসম ।

         ভারতবর্ষের বর্তমান অর্থনীতিতে মুদ্রহীন লেনদেন (cashless economy) -এর
যে ঝড় চলছে, সেই ঝড়ের সাক্ষী অসম বহন করছে প্রায় পাঁচশত বছর ধরে । 
পাঁচশত বছর পূর্বে মুদ্রাহীন অর্থনীতি মূলতঃ টিকে ছিল বিনিময় প্রথা অর্থাৎ  Barter System দ্বারা । এর মূল কথাটি হচ্ছে 'This for That' অথবা 'Trade instead of Pay' । ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রবেশ ঘটে এবং এই প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে । কিন্তু অসম এই প্রথাটিকে পুরোপুরি ভুলে যেতে রাজি না হয়ে এটিকে সংস্কৃতি তথা ঐতিহ্যের মধ্যে স্থান দেয় । এই ঐতিহ্যেরই বর্তমান প্রমাণ হচ্ছে মরিগাঁও জেলার জোনবিল মেলা ।

        অসমের রাজধানী দিশপুর থেকে মাত্র ৩০কি.মি. দূরে মরিগাঁও জেলার দয়াং বেলগুড়িতে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা যেখানে বিনিময় প্রথা এখনো জাগ্রত । প্রতি বছর মাঘ মাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহের বৃহস্পতি বারে শুরু হয় মেলাটি এবং শেষ হয় শনিবারে।

       'জোন' অর্থ 'চন্দ্র' আর 'বিল' অর্থ 'জলাভূমি' । ১৫ শতিকায় শুরু হয়েছিল এই 'জোনবিল  মেলা' । মধ্য অসমের তিওয়া জনগোষ্ঠী ও প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয়ের জনগোষ্ঠীদের  মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় তিনদিন ব্যাপী এই মেলাটি । রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মূলতঃ মেলাটির আয়োজন করা হতো তিওয়া জনগোষ্ঠী তথা আহোম  রাজাদের মধ্যে । 

       তিনদিন ব্যাপী এই মেলা শুরু হয় অগ্নি পূজা দিয়ে । তারপরেই হয় জোনবিল জলাশয়ে মাছ ধরার খেলা । বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন তিওয়া, কার্বি, খাসি , জয়ন্তিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোকেরা  নিজেদের  তৈরি করা সামগ্রী নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রধানতঃ পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিজের সামগ্রী বিনিময় করে সমতলের জনগোষ্ঠীদের সামগ্রীর সথে । উদাহরণস্বরূপ, পাহাড়ের মানুষেরা নিয়ে আসেন নানা ধরনের মশলা, বিভিন্ন ফল ইত্যাদি । সমতলের মানুষেরা নিয়ে আসে চাউল, মাছ , পিঠা ইত্যাদি । পাহাড়ের মানুষেরা এমন জিনিস নিয়ে আসে যেগুলো  সমতলে সহজলভ্য নয় এবং সমতলের মানুষেরা এমন জিনিস নিয়ে আসে যেগুলো পাহাড়ে সহজলভ্য নয় । অবশেষে উভয় পক্ষ নিজের নিজের প্রয়োজন অনুসারে সামগ্রী বিনিময় করে ।

       "Barter is the direct exchange of commodity or service for another without use of money ....."। মোটামুটি ১০,০০০ (দশ হাজার) গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর লোকেরা এই মেলায় অংশগ্রহণ করতে আসে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে । মেলার তিন দিন এরা যে শুধু সামগ্রী বিনিময় করে তা নয় , নিজেদের সময় তথা আবেগ , অনুভূতিও পরস্পর পরস্পরের সাথে বিনিময় করে । তারা বাঁশের তৈরি অস্থায়ী কুঁড়েঘরে একসঙ্গে থাকে ও খাওয়া-দাওয়া করে । এরই মাঝে তিওয়া জনজাতির রাজা যিনি গোভা রাজা নামে পরিচিত, তিনি তাঁর রাজসদস্যদের নিয়ে মেলা দর্শন করতে আসেন এবং প্রজাদের থেকে প্রথাগত কর সংগ্রহ করেন।

      জোনবিল মেলার মূল উদ্দেশ্য হলো উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জাতি - জনজাতির মধ্যে প্রীতি তথা ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা । তাই তো মেলাটি ব্যবসাকেন্দ্রিক না হয়ে, হয়ে উঠেছে সংস্কৃতিকেন্দ্রিক । তিনদিন ব্যাপী এই মেলার সমাপ্তি হয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীদের দ্বারা পরিবেশিত তাদের পরম্পরাগত নাচ-গান তথা খেলা পরিবেশনের মাধ্যমে । এভাবেই প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মন জয় করে এবং নিজের সংস্কৃতি তথা ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করে । অবশেষে এটুকু বলা যায় যে এভাবে সামগ্রী বিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের মধ্যে একতা ও সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করে যা আমাদের বর্তমান সমাজের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। 



         
পূরবী দে
সহকারী শিক্ষয়িত্ৰী 
ভাল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয় 
শিক্ষাখণ্ড - রানী

Post a Comment

0 Comments