বাক্যহীনা
প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাসে উঠল সাবিনা । ইস্ একটুও বসার জায়গা ফাঁকা নেই । বসার জায়গা পাওয়ার আশাও প্রায় নেই । বাসে বাদুড়ঝোলা ভিড় । একটু দেরি হলেই এমনটা হয় । পরবর্তী বাসে যে বসার জায়গা পাওয়া যাবে সেটারই বা কী ভরসা আছে । স্কুলে পৌঁছোতে দেরি হয়ে গেলেও বিপদ। শুনতে হবে প্রধান শিক্ষকের কথা । সহ্য করতে হবে কতজনের কত খোঁচা ।
সাবিনা বাস কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করল , " বসার জন্য সিট হবে না নাকি দাদা ? " " নেই ম্যাডাম , শিলচর বাসস্ট্যান্ডেই সিট বুকিং হয়ে গেছে । আসুন এদিকে। শালচাপরাতে এই সিটটি খালি হবে । বসতে পারবেন । এখন একটু কষ্ট করতে হবে , " - কন্ডাক্টর বলল ।
কাল সাবিনার ঘরে অতিথি এসেছে । তারা থাকবে কয়েকদিন । গুয়াহাটি থেকে এসেছে সাবিনার একমাত্র ননদ ও তার স্বামী , সঙ্গে তার ননদ ও শাশুড়ী । মোট চারজন লোক । সাবিনার সংসারে আছে স্বামী , দুই বছরের ছেলে শাফী , শাশুড়ী , ভাশুর , জা , দুই ভাশুরপো , শাফীকে দেখাশুনা করার জন্য একটি মেয়ে - ফুলি । সাবিনার স্বামী শাহিন বিদ্যুৎ বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী । ননদের শ্বশুরবাড়ি গুয়াহাটি , হাতিগাঁওতে । ওরা আসলে বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দির লোক । শ্বশুর গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন । সেই সুবাদে সেখানে বাসস্থান গড়েছেন ।
সাবিনা একজন স্কুল শিক্ষিকা । ওর স্কুল কাছাড় জিলার কাটিগড়ায় । বাস থেকে বদরপুরে নামতে হবে । সেখান থেকে স্কুলে পৌঁছাতে হলে বরাক নদী নৌকায় পার হয়ে আরও পাঁচ কিলোমিটার যেতে হবে অটোরিকশায় ।
অতিথিরা আসবে বলে সাবিনার উপর দুদিন ধরে খুব কাজের ধকল গেছে । ঘর-দোর একটু ভালো করে ঝেড়েমুছে পরিপাটি করে রাখা , গেস্টরুমের বেড কভার , পিলো কভার বদলানো , তারপর গেস্টরুমের লাগোয়া ওয়াশরুমটা ভালো করে পরিষ্কার ঝকঝকে করে রাখা ইত্যাদি । হাজার হোক ননদের বাড়ির কুটুম বলে কথা । ননদকে যাতে কোনো ধরনের লজ্জায় না পড়তে হয় । এসব বোঝে সাবিনা । তাই খুব খেয়াল রাখে ।
আজ সোমবার । স্কুলে যেতে হবে । সাবিনা ভোর পাঁচটায় উঠে লেগে গেল কাজে । রাত্রে শাহিনকে দিয়ে বাজার করিয়ে রেখেছে । ফুলিকে সঙ্গে নিয়ে পোলাও , ডিম , মুরগির মাংস ভুনা , কোর্মা , বেগুন-পুর ইত্যাদি বেশি করে রাঁধল , যেন সকাল-দুপুর দুবেলা কুলোয় কিছুটা হলেও । ঘুম থেকে উঠে শাহিন মাছ আনবে । কিন্তু সাবিনার তো সময়ে কুলোবে না , তাই ফুলিকে বলে রেখেছে সে যেন ভালো করে ভেজে দেয় মাছগুলো আর ডাল ও ভাত রাঁধে দুপুরে । অতিথিদের চা , কফি , নাস্তা ইত্যাদি যেন দিতে কোনো ভুল-ত্রুটি না করে , বার বার ফুলিকে বলে দিয়েছে সাবিনা ।
বাস কন্ডাক্টরের " শালচাপরা .. শালচাপরা .. " - বলে হাঁক শুনে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সাবিনা । যাক্ এবার তবে একটু বসার জায়গা পাওয়া যাবে ।
বাসের সিটে গা এলিয়ে দিল সে । চোখ বুজে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল । কিন্তু না , ঘুম আসছে না । কী সব এলোমেলো ভাবনায় বুকের ভিতরটা যেন ভারী হয়ে আছে । অনেক অপ্রকাশিত কথা আপন মনে বলতে ইচ্ছে করছে ।
সাবিনার ভাশুরের দুই ছেলে । বড় ছেলে ইলেভেনথ্ ক্লাসে সাইন্স স্ট্রিম-এ । ছোটো ছেলে ক্লাস নাইনে । ভাশুর দুবাইয়ে কর্মরত । তিনি সেখানে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একজিকিউটিভ ম্যানেজার । মোটা অঙ্কের মাইনে । জা গ্র্যাজুয়েট গৃহিণী । চাকরিতে যোগদান করেননি বলে কত যে আক্ষেপ তার। তিনি চাইলেই যে চাকরি পেতেন - এ কথাটা প্রতিদিন শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে সাবিনার । বাড়ির বড়োবউ ও পয়সাওয়ালা ছেলের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে তাকে ঘরোয়া কাজকর্ম বেশি করতে হয় না । সাবিনার বিয়ের পরই শাশুড়ী নিয়ম করে দিয়েছিলেন যে ছোটোবউ রান্নাঘর সামলাবে আর বড়োবউ তদারকি করবে । চাকরি করলে কি হল - বাড়ির বউ তো বউই । সাবিনা ঘর-কর্মস্থল সামলাতে সামলাতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে । তাই বাবার বাড়ির কাজের মাসির মেয়ে ফুলিকে নিয়ে এসেছে । ফুলিকে রাখার জন্যও কত কথা শুনতে হয় সাবিনাকে । " আমরা এত মানুষ ঘরে থাকতে কাজের মেয়ে রাখার কি দরকার ? পার্ট টাইম কাজের লোক তো আছেই । ঝাড়পোঁছ তো করছেই । নিজে একটু কাজকর্ম না করলে যে কমবয়সে শরীরে হাজারটা রোগ বাসা বাঁধবে । সারাদিনই তো স্কুলে থাক। বসে বসে সময় কাটাও । পড়ানো কি আর এমন খাটুনির কাজ । একটু সময় ঘরের কাজ কর্ম করলে কি হয় ? " - শাশুড়ী বলেন ।
স্পষ্টবাদী সাবিনা দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো হজম করে নেয় । যাই বলুন না কেন তিনি যে শাশুড়ীমা , বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। সাবিনা ভালোমতই বোঝে যে সব জায়গায় কথার উপর কথা বলতে নেই। এটা তার স্কুল নয় , কলেজ নয় বা কর্মস্থল নয় , এটা তার সংসার, তার শ্বশুরবাড়ি । " জি আম্মা। আমি কি বসে বসে খাই নাকি ? ও তো সারাদিন স্কুলে থাকে । আমাকেই তো ঘরদোর সামলাতে হয় । ও কেন মিছিমিছি মেয়েটা নিয়ে আসল ? বাড়তি বোঝা। খাওয়াও , পরাও , মাইনে দাও " - বড় জা যোগ দিলেন শাশুড়ীর সঙ্গে ।
" বদরপুর ঘাট .. বদরপুর ঘাট .. " - বলে বাস কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঝটপট উঠে নেমে পড়ে সাবিনা । তড়িৎ গতিতে গিয়ে উঠে নৌকায় । নদী পার হয়ে আরেক দৌড়ে কাটিগড়া বাজারে গিয়ে উঠে অটোরিকশায় । পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পর অটোরিকশা থেকে নেমে দুশো মিটার পায়ে হেঁটে গিয়ে পৌঁছায় স্কুলে ।
স্কুল থেকে ফেরার পথে চেরাগী বাজারে নেমে নদী পার হয় সাবিনা । বদরপুর মিশন রোড হয়ে যাবে রিক্সায় । বদরপুর বাজারে ভালো ভালো কাপড়ের দোকান আছে । আত্মীয়দের জন্য কিছু উপহার কিনে নেবে এখান থেকে । এই কয়দিন স্কুল খোলা আছে তাই বাজারে যাওয়ার জন্য আলাদা সময় পাওয়া যাবে না ।
ঘরে ফিরে সন্ধ্যায় ননদকে ডেকে কাপড়ের ব্যাগ হাতে তুলে দিল । ননদের জন্য গাউন, ননদের ননদের জন্য সালোয়ার কামিজ, শাশুড়ীর জন্য তাঁতের শাড়ি ও নন্দাই-এর জন্য ব্রান্ডেড শার্ট । সঙ্গে নিজের শাশুড়ীর জন্যও একটা তাঁতের শাড়ি কিনল । দেখে ভালো লেগেছিল শাড়িটা, তাই কিনে ফেলল ।
" ভাবি তুমি তো খুব চালাক দেখি । আগেভাগেই কাপড়-চোপড় কিনে নিয়ে আসলে । আমাদের সঙ্গে নিয়ে গেলে শিলচর নাহাটা টেক্সটাইল থেকে নিজের পছন্দে কেনাকাটাও করতাম আর একটু ঘুরোঘুরি করে রেস্টুরেন্টে খেয়েও আসতাম । তুমি তো কোনদিনই বেড়াতে নিয়ে যাও না । বড়ো ভাবি তো প্রত্যেকবারই বেড়াতে নিয়ে যায় , বাজারে নিয়ে যায় , নিজের বাবার বাড়িও নিয়ে যায় .. " - সাবিনার ননদ বলল ।
ক্লান্ত সাবিনা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল । আপনাআপনিই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো , " আমার যে স্কুল । "
" স্কুল ! স্কুল ! খালি স্কুলের বাহানা । স্কুল থেকে কি একদিনের জন্য ছুটি নেওয়া যায় না ? আমার মেয়েটা এসেছে কতদূর থেকে। বছরে দুবারও আসতে পারে না .. " - শাশুড়ী বললেন ।
সাবিনা চুপচাপ চলে যায় নিজের রুমে । যেতে যেতে শোনে বড় জা বলছেন - " আমার চাচিও স্কুলের মাস্টারনি ছিলেন । সপ্তাহে দেখতাম তিন-চারদিন স্কুলে গেলেই হত । আত্মীয়-স্বজন সবাইকে কত সময় দিতেন । এত ' স্কুল স্কুল ' করতে দেখিনি গো কখনও । "
ঘুমন্ত শাফীকে আঁকড়ে ধরে চুপচাপ শুয়ে থাকে সাবিনা । কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করে । মনে করার চেষ্টা করে শেষ কবে গিয়েছিল তার বাবার বাড়ি হোজাইতে । এগারো মাস হয়ে গেল বোধহয় । হিসেব রাখারই অবকাশ মেলে না । মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মহুয়া'র সেই 'সবলা' কবিতার লাইন -
নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা ?
নত করি মাথা
পথপ্রান্তে কেন রব জাগি
ক্লান্তধৈর্য প্রত্যাশার পূরণের লাগি
দৈবাগত দিনে ?
শুধু শূন্যে চেয়ে রব ? কেন নিজে নাহি লব চিনে
সার্থকের পথ ?
------------------------------ ----------------------------
------------------------------ ----------------------------
হে বিধাতা , আমারে রেখো না বাক্যহীনা --
রক্তে মোর জাগে রুদ্রবীণা ।
সাবিনা মুচকি হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে - " হায় কবিগুরু ! নারী যতই ভাগ্য জয় করুক , যতই অধিকার আদায় করুক , যতই প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হোক , যতই সার্থকের পথ চিনুক না কেন , যতই রক্তে জাগুক না কেন রুদ্রবীণা , কিছু কিছু জায়গায় তাকে বাক্যহীনা থাকাতেই এই সংসারের শান্তি বহাল থাকে । "
মাসকুরা বেগম
সহকারী শিক্ষিকা
চাম্পুপারা উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
শিক্ষাখন্ড - ছয়গাঁও
2 Comments
বাস্তৱ সন্মত গল্প, পঢ়ে মনের খোৰাক পেলাম
ReplyDeleteখুব সুন্দর হয়েছে ছোট গল্পটি। গল্প হলে ও সত্যি মনে হচ্ছে। সমাজে এরূপ অবস্থা অহরহ ঘটছে। প্রসংগ ক্রমে আমার বাড়ির পাশের মিশন রোডের কথা উঠেছে, আর তুমি ও এই রাস্তা দিয়ে বেশিরভাগ গমনা গমন করেছো। তবে তোমার অবস্থা সাবিনার মতো কখনো হয়নি। তবে একটা কথা না বলে পারছি না। নারীরা নারীদের শত্রু, পুরুষরা নয়। আরও গল্প শুনার প্রত্যাশায় থাকলাম।
ReplyDelete